জঙ্গল বিষয়ে কিছু কথা (A few words about Forest)
জঙ্গল বিষয়ে কিছু কথা (A few words about Forest)
- সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
- 22 Jan 2025
আমাদের মধ্যে অনেকে রয়েছেন যারা জঙ্গলকে (ফরেস্ট/Forest) খুব ভালোবাসেন, প্রকৃতির হাতছানিতে, জীবজন্তু কিংবা উদ্ভিদের আকর্ষণে প্রায়ই, বা সপ্তাহান্তে, বেরিয়ে পড়েন জঙ্গলের উদ্দেশ্যে। আমার এই ব্লগের উদ্দেশ্য জঙ্গল সম্বন্ধে প্রাথমিক আলোচনা করা, বিভিন্ন প্রকার সংরক্ষিত স্থান (মূল উদ্দেশ্য- সংরক্ষণ), বিভিন্ন প্রকার জঙ্গলের (পরিবেশগত ভাবে) আলাদা আলাদা চরিত্র ইত্যাদি নিয়ে একটু চর্চা করা। প্রথমেই সংরক্ষিত স্থান হিসেবে জঙ্গলকে দেখা যাক। সংরক্ষিত স্থানকে আমরা প্রধানত তিনটি ভাগে বিভক্ত করতে পারি। যেমন ন্যাশনাল পার্ক (National Park), ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি (Wildlife Sanctuary), এবং বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ (Biosphere Reserve)। পশ্চিমবঙ্গে সংরক্ষিত স্থান বা প্রোটেক্টেড এরিয়ার (Protected area) মধ্যে রয়েছে ছয়টি ন্যাশনাল পার্ক (সিঙ্গালিলা, নেওরা ভ্যালি, গরুমারা, বক্সা, সুন্দরবন, জলদাপাড়া), ষোলোটি স্যাংচুয়ারি (সেঞ্চল, মহানন্দা, চাপড়ামারি, বক্সা, সজনেখালি, হ্যালিডে, লোথিয়ান, রায়গঞ্জ, চিন্তামণি কর, বিভূতিভূষণ, জোড়পোখরি, বল্লভপুর, রমনাবাগান, পশ্চিম সুন্দরবন, পাখি বিতান), দু’টি করে বাঘ রিজার্ভ (বক্সা, সুন্দরবন) আর হাতি রিজার্ভ (ময়ূরঝর্ণা, পূর্ব ডুয়ার্স), এবং একটি বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ (সুন্দরবন)। কাজেই বোঝা যাচ্ছে হাতের কাছেই রয়েছে অনেক পছন্দ, সময় সুযোগ মতন বেছে নিলেই হলো।
ন্যাশনাল পার্ক, স্যাংচুয়ারি, বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ-র মধ্যে চরিত্রগত পার্থক্য রয়েছে। একটু সহজ করে এদের মধ্যে পার্থক্যটা বলা যাক।
ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ হেতু প্রতিষ্ঠিত। তুলনামূলকভাবে এর আয়তন কম হয়ে থাকে, অনেক সময় সীমানা খুব একটা নির্দিষ্ট করা থাকে না। সীমাবদ্ধতা থাকলেও কিছু কার্যকলাপ করা যেতে পারে, যেমন পশু চারণ, ঔষধি গাছ গাছড়া সংগ্রহ, কিছু সময় জ্বালানি শুকনো কাঠ, পাতা সংগ্রহ ইত্যাদি, তবে কোনো মতেই শিকার বা বন্য প্রাণীর ক্ষতি করা নয়।
ন্যাশনাল পার্ক কিন্তু শুধুমাত্র বন্যপ্রাণী নয়, তার সাথে উদ্ভিদ, ঐতিহাসিক কোনো প্রকার স্থাপত্য ইত্যাদি সকল অর্থাৎ প্রাণী, উদ্ভিদ, এবং নির্জীব পদার্থ সহ সম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্রকে সংরক্ষণ করে। ন্যাশনাল পার্কের সীমানা অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট এবং এখানে মানুষের কার্যকলাপ একেবারেই সীমাবদ্ধ।
এবার আসি বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের কথায়। বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ কিন্তু উপরোক্ত দুই প্রকার সংরক্ষিত স্থান বা প্রোটেক্টেড এরিয়া থেকে তুলনামূলকভাবে অনেক বড় হয়। এটি সম্পূর্ণ জীব বৈচিত্রকে সংরক্ষণ হেতু স্থাপন করা হয় এবং এটি কিন্তু ওই অঞ্চলে বসবাসকারী জনজাতিদের উন্নতিকল্পে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ন্যাশনাল পার্কের মতন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের সীমানাও কিন্তু অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট এবং এর মধ্যে কিন্তু ন্যাশনাল পার্ক, স্যাংচুয়ারি থাকতে পারে। যেমন পাঁচমাড়ি বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের মধ্যে সাতপুরা ন্যাশনাল পার্ক, এবং কয়েকটি স্যাংচুয়ারি যথা বরি স্যাংচুয়ারি, পাঁচমাড়ি স্যাংচুয়ারি রয়েছে। আমাদের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে রয়েছে সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ। এই বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভকে কয়েকটি অঞ্চল বা জোনে (Zone) ভাগ করা যায়। যেমন একেবারে কেন্দ্রে থাকে কোর অঞ্চল (Core zone), এখানে কিন্তু কোনো প্রকার মনুষ্য কার্যকলাপ করা যায়না, এটি অন্ত্যন্ত গভীর বন। এর পর থাকে বাফার অঞ্চল (Buffer zone), এই অঞ্চলে পশুচারণ, পর্যটন ইত্যাদি কিছু মনুষ্য কার্যকলাপ সম্ভব। এর পরবর্তী অঞ্চলটি হলো ট্রানজিশন অঞ্চল (Transition zone), এখানে মানুষের বসতি, চাষবাস দেখা যায়।

এ তো গেলো সংরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে জঙ্গলের বিবরণ। এবার আসি পরিবেশগত ভাবে বিভিন্ন ধরণের জঙ্গলের বর্ণনায়। যদি আপনি জঙ্গলের প্রকৃতির দিকে তাকান তবে প্রত্যেক জঙ্গলের প্রকৃতি আপনার কিন্তু একই রকম লাগবে না, প্রকৃতির বৈচিত্র আপনার চোখে পড়বে। একটু সহজ ভাবে বলি, উত্তরবঙ্গ বেড়াতে গিয়ে জলদাপাড়া, গরুমারা কিংবা নেওরা ভ্যালি ঘুরে এলেন আবার দক্ষিণবঙ্গের সুন্দরবন বেড়ালেন, দু’টো তো আর এক হলো না, সেটাই বলছি। এই যে পার্থক্য সেটা নির্ভর করে ওই স্থানের জলবায়ুর উপর, অর্থাৎ ওই স্থানের তাপমাত্রা কত, বছরে বৃষ্টিপাত কেমন হয় ইত্যাদি, যা আবার স্থানটির ভৌগোলিক অবস্থানের উপর নির্ভর করে। এই বিভিন্ন আবহাওয়া, জলবায়ু, মৃত্তিকার প্রকৃতি ইত্যাদির উপর নির্ভর করে সেই স্থানের বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ জন্ম নেয়, এই উদ্ভিদ কিন্তু জঙ্গল বাস্তুতন্ত্রের প্রধান উপাদান।
জঙ্গল প্রধানত তিন প্রকার, যেমন বোরিয়াল ফরেস্ট (Boreal forest), টেম্পারেট ফরেস্ট (Temperate forest) এবং ট্রপিক্যাল ফরেস্ট (Tropical forest)। বোরিয়াল ফরেস্ট তাইগা (Taiga) নামেও পরিচিত, এই প্রকার ফরেস্ট সাবআর্কটিক অঞ্চলে দেখা যায়। সাবআর্কটিক অঞ্চলটি হলো উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত আর্কটিক সার্কেলের (Arctic circle) দক্ষিণ অংশ। উত্তরের তুন্দ্রা (Tundra) অঞ্চল থেকে দক্ষিণের টেম্পারেট অঞ্চলের মধ্যবর্তী স্থানে এই প্রকার ফরেস্ট দেখা যায়। আলাস্কা, কানাডা, স্ক্যান্ডেনেভিয়া, সাইবেরিয়া স্থানগুলিতে এই প্রকার জঙ্গল দেখা যায়। রাশিয়াতে পৃথিবীর বৃহত্তম তাইগা রয়েছে। এই জঙ্গলের উদ্ভিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্প্রুস (Spruce), পাইন (Pine), ফার (Fir) ইত্যাদি কনিফেরাস (Coniferous) উদ্ভিদগুলি (যাদের পাতাগুলি সুচের মতন সরু, পাতানো বৃহৎ নয়)। প্রাণীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিভিন্ন ধরণের রোডেন্ট (Rodents), বড়ো প্রজাতির হরিণ (Deer), মুস (Moose), ভাল্লুক (Bear), লিনক্স (Lynx), আর সাইবেরিয়ান বাঘের (Siberian tiger) কথা তো সকলেরই জানা, পাখিদের মধ্যে রয়েছে ঈগল (Eagle), পেঁচা (Owl) ইত্যাদি। এই তাইগা আবার দু’ধরণের হয়ে থাকে, সাধারণত উচ্চ অক্ষাংশে পাওয়া যায় ওপেন ক্যানোপি বোরিয়াল ফরেস্ট (Open canopy boreal forest; ‘ক্যানোপি’ কথাটির অর্থ ছাউনি) যা আবার লাইকেন জঙ্গল বলেও পরিচিত। ঠান্ডা অধিক হওয়ার দরুন এখানে জীব বৈচিত্র কম হয়ে থাকে। নিম্ন অক্ষাংশে রয়েছে ক্লোস্ড ক্যানোপি বোরিয়াল ফরেস্ট (Closed canopy boreal forest), এখানে আবহাওয়া একটু কম রুক্ষ, কাজেই জীব বৈচিত্র তুলনামূলক ভাবে বেশি।
এর পর আসি টেম্পারেট ফরেস্টে। নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে এই প্রকার ফরেস্ট টেম্পারেট অঞ্চলে পাওয়া যায়। সাধারণভাবে নিম্ন অক্ষাংশে (উত্তর গোলার্ধে ৬৬.৫ ডিগ্রী থেকে ২৩.৫ ডিগ্রী, আবার দক্ষিনে গোলার্ধেও তাই) অবস্থিত টেম্পারেট অঞ্চল, এখানে সূর্যরশ্মি তির্যকভাবে পড়ে কাজেই তাপমাত্রা কমের দিকে থাকে এবং বছরে চারটি ঋতু যথাক্রমে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, এবং বসন্ত পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। টেম্পারেট ফরেস্টে আবার তিন প্রকার, পর্ণমোচী বা ডেসিডুয়াস ফরেস্ট (Deciduous forest), কনিফেরাস ফরেস্ট (Coniferous forest) এবং টেম্পারেট রেন ফরেস্ট (Temperate rain forest)। ডেসিডুয়াস ফরেস্টের উল্লেখযোগ্য উদ্ভিদগুলি হলো ম্যাপেল (Maple), ওক (Oak), চেস্টনাট (Chestnut), গিংগো বাইলোবা (Ginkgo biloba) ইত্যাদি। ডেসিডুয়াস উদ্ভিদগুলি শীতকালে তাদের সমস্ত পাতা ঝরিয়ে দেয়। বাতাসে আর্দ্রতা এতটাই কম হয় যে পাতা গুলি শুকিয়ে ঝরে পরে যায়, আবার শীতকাল অতিক্রমিত হলে বসন্তের শুরুতে আবার নতুন পাতায় ভরে ওঠে, বড়ই দৃষ্টিনন্দন হয় সেই সময়। এই সময় পৃথিবীর অনেক শহরের মতন আমাদের (বর্তমান বসবাসের) শহর আনদং -এও চেরি ব্লসম (Cherry blossom) হয়ে থাকে, রাস্তার দু’পাশে গাছ গুলি ফুলে ভরে ওঠে। অসাধারণ সুন্দর লাগে এ দৃশ্য।

অপরপক্ষে কনিফেরাস উদ্ভিদগুলির পাতা সূঁচের ন্যায় হয়ে থাকে, এই অভিযোজন নিজের প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা ধরে রাখতে এবং এদের বীজগুলি কাষ্ঠল কোণের (Cone) ভিতরে থাকে। আগেই উল্লেখ করেছি এই জাতীয় উদ্ভিদ হলো পাইন (Pine), ফার (Fir), সিডার (Cedar), হেমলক (Hemlock), জুনিপার (Juniper), স্প্রুস (Spruce), লার্চ (Larch) ইত্যাদি। এছাড়াও টেম্পারেট অঞ্চলের কিছু জায়গায় বছর বেশ বৃষ্টিপাত হয়, সেখানে যে ফরেস্ট গড়ে ওঠে তা হলো টেম্পারেট রেন ফরেস্ট। এর উদাহরণ উত্তর আমেরিকার আপালাচিয়ান রেন ফরেস্ট (Appalachian temperate rain forest), দক্ষিণ আমেরিকার ভালদিভিয়ান (Valdivian temperate rain forest) এবং ম্যাগেলানিক রেন ফরেস্ট (Magellanic temperate rain forest), ইউরোপের কোলচিয়ান রেন ফরেস্ট (Colchian temperate rain forest) ইত্যাদি। এবার আসি নিজেদের দেশে। আমাদের পূর্ব হিমালয়ান যে ব্রডলিফ ফরেস্ট (East Himalayan broadleaf forest) রয়েছে তাও কিন্তু এই রেন ফরেস্টের উদাহরণ। বিভিন্ন ধরণের ওক (Oak), রোডোডেনড্রন (Rhododendron), ম্যাগনোলিয়া (Magnolia), সিনামোন (Cinnamon), হিমালয়ান ম্যাপেল (Himalayan maple), হিমালয়ান বার্চ (Himalayan birch), বার্চ (Birch), পার্সিয়ান ওয়ালনাট (Persian walnut) ইত্যাদি উদ্ভিদ এই জঙ্গলে দেখা যায়। গোল্ডেন লাঙ্গুর (Gee’s Golden langur), সাদা পেট বিশিষ্ট ইঁদুর (Brahma white-bellied rat), জায়ান্ট ফ্লাইং স্কুইরেল (Hodgson’s giant flying squirrel, Namdapha flying squirrel), টাকিন (Takin), হিমালয়ান শিরো (Himalayan serow), ম্যাকাক বাঁদর (Macaque), লাল পান্ডা (Red panda), ক্লাউডেড লেপার্ড (Clouded leopard) ইত্যাদি এই জঙ্গলের প্রাণী। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ধরণের পাখি। কাজেই এদের দেখতে যেতে পারেন অরুণাচল প্রদেশের ঈগল নেস্ট ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি (Eagle nest Wildlife Sanctuary), মৌলিং ন্যাশনাল পার্ক (Mouling National Park)), কামলাং ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি (Kamlang Wildlife Sanctuary), নামদাফা ন্যাশনাল পার্ক (Namdapha National Park), পশ্চিমবঙ্গের নেওরা ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক (Neora valley National Park) ইত্যাদি।
এই প্রসঙ্গে স্তন্যপায়ী এবং সরীসৃপ প্রাণীদের বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনার জন্যে ক্লিক করুন।
অবশেষে আসি ট্রপিক্যাল ফরেস্টে। আমাদের সকলেরই জানা আছে পৃথিবীর ট্রপিক্যাল অঞ্চলটি, ক্যান্সার (Cancer) এবং ক্যাপ্রিকর্ন (Capricorn) অক্ষাংশের মধ্যবর্তী অঞ্চল হলো ট্রপিক্যাল অঞ্চল। আমাদের দেশ ভারতবর্ষের অধিকাংশই এর মধ্যে অবস্থান করে। সূর্যালোক অধিক পরিমানে প্রাপ্ত হওয়ায় এই অঞ্চল উষ্ণ হয় আর জীব বৈচিত্রে পূর্ণ। এই প্রকার জঙ্গলের সান্নিধ্যেই আমি জীবনের অনেকটা অতিবাহিত করেছি, কখনও উত্তর-পূর্বে, আবার কখনও মধ্য ভারতে। জঙ্গলকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় মানুষের জীবন। সে জ্বালানির শুকনো কাঠ কুড়োয়, পাতা কুড়িয়ে আনে, গৃহপালিত পশু চড়ায়, ফল-মূল-মধু সংগ্রহ করে। সে ঔষধি গাছ গাছড়া চেনে, রোগের উপশমে প্রাকৃতিক উপাদানগুলিকে ব্যবহার করার বিপুল তথ্য রয়েছে তাঁর জ্ঞানভাণ্ডারে, বিভিন্ন ফসলের স্থানীয় ভ্যারাইটি (Variety) সংরক্ষণ করে, জিন পুল (Gene pool) কে ক্ষয় হতে দেয় না। জঙ্গলের সাহচর্যে বেড়ে ওঠা মানুষ অনুভব করতে পারেন জঙ্গলকে, বনভূমির সাথে তাঁর আত্মার যোগাযোগ, সে তাঁর জীবনযাত্রার মধ্যে দিয়েই পরিচর্যা করে প্রকৃতির। তাঁদের থেকে আমরা শিখি, শেখার চেষ্টা করি। বর্তমানে যে পরিবেশের ধারণক্ষমতার (Environmental Sustainability) উপর আমরা গুরুত্ব আরোপ করি, তা কিন্তু এই সকল জনজাতি সহস্র বছর ধরে তাঁদের জীবনধারণের মধ্যে দিয়ে অনুশীলন করে আসছেন। এই বিপুল অমূল্য জ্ঞান ভান্ডারকে সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব। ট্রপিক্যাল ফরেস্টকে আমরা প্রধানত চারভাগে ভাগ করতে পারি। যেমন চিরহরিৎ রেন ফরেস্ট (Evergreen rain forest), ট্রপিক্যাল আর্দ্র ফরেস্ট (Tropical moist forest), ট্রপিক্যাল শুষ্ক ফরেস্ট (Tropical dry forest), এবং পরিশেষে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট (Mangrove forest)। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপে, উত্তর-পূর্বে, পশ্চিমঘাটে (যে স্থানগুলিতে বছরে ২৩০ সেন্টিমিটারের মতন বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে) যে বনভূমি রয়েছে তা চিরহরিৎ ফরেস্ট। রাবার (Rubber), সিঙ্কোনা (Cinchona), রোজউড (Rosewood), মেহগনি (Mahogany), এবনি (Ebony), টিক (Teak), ইন্ডিয়ান লরেল (Indian Laurel) ইত্যাদি এই জঙ্গলে পাওয়া যায়। এই অঞ্চলে বছরে প্রায় ২০০ সেন্টিমিটারের বা বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। ট্রপিক্যাল আর্দ্র ফরেস্ট (বৃষ্টিপাতের পরিমান বছরে ১০০ থেকে ২০০ সেন্টিমিটার), এবং শুষ্ক ফরেস্ট (বৃষ্টিপাতের পরিমান বছরে ৭০ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার) নির্ভর করে ওই অঞ্চলের বৃষ্টিপাতের পরিমানের উপর। চন্দন (Sandalwood), বাঁশ (Bamboo), শাল (Sal), কুসুম (Kusum), খয়ের (Khoir), মালবেরি (Mulberry), শিশু (Shishu), কেন (Cane), অর্জুন (Arjun) ইত্যাদি আর্দ্র বনভূমিতে পাওয়া যায়। পশ্চিমঘাটের পূর্ব ঢাল, ছোটনাগপুর মালভূমি, ঝাড়খন্ড, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা এবং উত্তর পূর্বের কিছু অংশে এই প্রকার বনাঞ্চল দেখা যায়। অপরপক্ষে টিক (Teak), নিম (Neem), পিপল (Peepal), শাল (Sal), খয়ের (Khoir), বেল (Bel), পলাশ (Palash), লরেল (Laurel) ইত্যাদি শুষ্ক বনভূমিতে পাওয়া যায়। বিহার, উত্তর প্রদেশ, উত্তর এবং পশ্চিম ভারতের কিছু অঞ্চলের বনভূমি এই প্রকার। উপকূল অঞ্চলে যে বনভূমি দেখা যায়, সেটি ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। এখানকার উদ্ভিদগুলি লবনাক্ত মাটি এবং খাড়ির জলে বেঁচে থাকার জন্যে উপযোগী অভিযোজন করেছে, যেমন শ্বাসমূল। সুন্দরী (Sundari), গরান (Garan), গেঁওয়া (Genwa), গোলপাতা (Golpata), হেঁতাল (Hental), গর্জন (Garjan), ধুঁধুল (Dhundhul), পশুর (Pashur), হোয়া (Hoya), কেওড়া (Keora) ইত্যাদি এই বনভূমিতে পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন (Sundarbans), ওড়িশার ভিতরকণিকা (Bhitarkanika) ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের উদাহরণ।
আশা করি, জঙ্গল সম্বন্ধে আমি একটা পরিষ্কার ধারণা দিতে পেরেছি। বেড়াতে যাওয়ার পূর্বে সহজেই বুঝে নিন সেই জঙ্গলের প্রকৃতি এবং উদ্দেশ্য, বেড়ানোর পরিকল্পনা করুন সেই মতন।
বি.দ্র. প্রবন্ধটি ৯ই ডিসেম্বর ২০২২ সালে আমার ব্লগে প্রথম প্রকাশিত হয়, পুনরায় প্রবন্ধটি এই সাইটে প্রকাশিত হলো।
Blogs
Our Latest Blogs
পূর্ববর্তী ব্লগটিতে আমি সুস্থায়ী খাদ্য ও পুষ্টি সুরক্ষায় ঐতিহ্যগত জ্ঞান কেন আবশ্যিক সেই বিষয়ে আলোচনা করেছি। সেখানে প্রধানত আমি কারণগুলিকে উল্লেখ করেছি, তবে বিশদে উদাহরণ সহযোগে সেগুলি বর্ণনার অবকাশ এখনও রয়েছে, সে বিষয়ে আমি পরে অবশ্যই লিখবো। বর্তমান ব্লগটিতে আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে কি কি উপায়ে সুস্থায়ী খাদ্য এবং পুষ্টি সুরক্ষায় এই ঐতিহ্যবাহী খাদ্যগুলি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে সেই বিষয়ে আলোচনা করবো।
- সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
- 27 Jan 2025
বর্তমান আলোচনায় প্রথম প্রয়োজন ঐতিহ্যগত জ্ঞান (বা Traditional Knowledge) কি সেটা বোঝা। ঐতিহ্যগত জ্ঞান বলতে বোঝায় সঞ্চিত জ্ঞান, অনুশীলন, দক্ষতা, উদ্ভাবন এবং প্রজ্ঞাকে যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কোনো সম্প্রদায় বা সমাজের মধ্যে সময়ের সাথে সাথে প্রবাহিত হয়।
- সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
- 27 Jan 2025
মাছে -ভাতে বাঙালী। খাদ্য নির্বাচনের সূত্র মেনেই জলবহুল বাংলায় অনাদিকাল থেকেই মাছ বাঙালীর খাদ্য হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে। মাছ চিরকালই বাঙালির রসনাকে তৃপ্ত করার পাশাপাশি পুষ্টি প্রদান করে এসেছে।
- সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
- 27 Jan 2025
পূর্ববর্তী ব্লগে পরাগসংযোগকারী কীট-পতঙ্গ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছিলাম (অনুগ্রহ করে পড়ুন খাদ্য এবং পুষ্টি নিশ্চয়তায় পরাগ-সংযোগকারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা)। বর্তমান ব্লগটিতে কীট-পতঙ্গ ছাড়া অন্য কয়েকটি প্রাণী নিয়ে আলোচনা করবো যারাও পরাগায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
- 27 Jan 2025
কীট-পতঙ্গ, বিশেষত পরাগ বহনকারী বা পরাগ-সংযোগকারী কীট-পতঙ্গ (Pollinator), আমাদের খাদ্য উৎপাদনের জন্যে অপরিহার্য। যে সকল খাদ্যশস্য আমরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করি তার প্রায় ৭৫% পরাগ-সংযোগকারী প্রাণীদের উপর নির্ভর করে, এই সকল পরাগ-সংযোগকারী প্রাণীদের মধ্যে কীট-পতঙ্গ উল্লেখযোগ্য।
- সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
- 26 Jan 2025
ইতিপূর্বে খাদ্যের রূপান্তরের সম্বন্ধে একটি ব্লগে আমি সবিস্তারে আলোচনা করেছি। বর্তমানেও এর ধারা অব্যাহত। এর পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে, যেমন অর্থনৈতিক উন্নতি বা আয় বৃদ্ধি, নগরায়ন, এবং অবশ্যই বিশ্বায়ন। বর্তমান আলোচনাটি আমি সীমাবদ্ধ রাখবো খাদ্য ব্যবস্থার উপরে বিশ্বায়নের প্রভাবের বিষয়ে।
- সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
- 26 Jan 2025
আমরা আমাদের খাদ্যের দিকে একটু তাকাই, দেখবো খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে, তা ব্যবহার হচ্ছে এবং অব্যবহৃত অংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এটা একটা সরলরেখার ন্যায় (Linear economy)। উৎপাদন-ব্যবহার-নষ্ট (Make-Take-Waste)। কিন্তু এই যে অংশটি ব্যবহার হচ্ছে না, তা উৎপাদন করতেও তো পয়সা লেগেছে। শুধু যে পয়সা লেগেছে, এমনটা নয়, জমি লেগেছে, জল লেগেছে, সার লেগেছে, আবার সেই অতিরিক্ত সার পরিবেশের উপর ঋণাত্মক প্রভাবও ফেলেছে - এ সকলই তো বৃথা গেলো, কোনো উপকার তো হলোই না, বরং অপকার হলো। কাজেই, এই উৎপাদন-ব্যবহার-নষ্ট (Make-Take-Waste) মডেলটি কার্যকরী হচ্ছে না। তবে কি করতে হবে? এই সরলরৈখিক সম্পর্কটিকে বৃত্তাকার সম্পর্কে (Circular economy) পরিণত করতে হবে।
- সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
- 26 Jan 2025
আনদং থেকে সাড়ে ন'টার বাসে রওনা হয়ে পূর্ব সোলে (Dong Seoul) এসে পৌঁছলাম প্রায় দুপুর সোয়া এক'টায়। সেখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা রেস্তোরাঁ।
- সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
- 26 Jan 2022
পূর্বের একটি ব্লগে আমি (বাস্তুতন্ত্রের সেবা প্রদান এবং খাদ্য) বাস্তুতন্ত্র কিরূপে আমাদের খাদ্য সংস্থান বিষয়ে পরিষেবা প্রদান করে সেই সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছি। এই ব্লগটিতে বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে খাদ্য সংকট উৎপন্ন হচ্ছে তার মোকাবিলা বাস্তুতন্ত্রের উপর নির্ভর করে কিরূপে করা সম্ভব তার উপর আলোচনা করবো।
- সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
- 23 Jan 2025
'আঃ বড্ড দাম নিচ্ছ, তরকারীতে তো হাত দেওয়ার উপায় নেই গো'। খদ্দেরের অভিযোগ শুনে বিক্রেতা একগাল হেসে, 'আমরাও তো দাম দিয়ে কিনে আনি বাবু, কতটুকু আর লাভ থাকে! তবে মাল আমার এখানে এক্কেবারে টাটকা' এই বলে প্রয়োজনীয় সব্জিগুলি খদ্দেরকে গুছিয়ে দিয়ে দেয়।
- সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
- 22 Jan 2025
পূর্বে একটি ব্লগে আমি বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদের সংরক্ষিত স্থান, বিভিন্ন প্রকারের জঙ্গলের বিষয়ে একটা প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আজ আলোচনা করবো এই জঙ্গলের বন্য প্রাণ নিয়ে।
- সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
- 22 Jan 2025
পূর্বের ব্লগটিতে আমি বিভিন্ন প্রকার ফরেস্ট বা জঙ্গলের বর্ণনা করেছি। এই ব্লগটিতে আমি দক্ষিণ কোরিয়ার ফরেস্টের কয়েকটি ছবি দিলাম, বছরের বিভিন্ন সময় টেম্পারেট ফরেস্টের বিভিন্ন রূপ।
- সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
- 22 Jan 2025
আমাদের মধ্যে অনেকে রয়েছেন যারা জঙ্গলকে (ফরেস্ট/Forest) খুব ভালোবাসেন, প্রকৃতির হাতছানিতে, জীবজন্তু কিংবা উদ্ভিদের আকর্ষণে প্রায়ই, বা সপ্তাহান্তে, বেরিয়ে পড়েন জঙ্গলের উদ্দেশ্যে। আমার এই ব্লগের উদ্দেশ্য জঙ্গল সম্বন্ধে প্রাথমিক আলোচনা করা, বিভিন্ন প্রকার সংরক্ষিত স্থান (মূল উদ্দেশ্য- সংরক্ষণ), বিভিন্ন প্রকার জঙ্গলের (পরিবেশগত ভাবে) আলাদা আলাদা চরিত্র ইত্যাদি নিয়ে একটু চর্চা করা।
- সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
- 22 Jan 2025
এবার একটু সরীসৃপ (Reptiles; class: Reptilia) প্রাণীদের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। আনদং-র চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ তাঁদের সংগ্রহে অনেক সরীসৃপ প্রাণী এখানে প্রদর্শনের জন্যে রেখেছেন।
- সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
- 22 Jan 2025
আনদং-এ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্নিকটে, ১০ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যেই একটি ছোট চিড়িয়াখানা রয়েছে। আমরা সপ্তাহান্তে প্রায়ই সেখানে যাই।
- সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
- 22 Jan 2025
ইতিপূর্বে পুষ্টি সুরক্ষা ও খাদ্য সংস্থান সম্পর্কিত ৪ টি পর্ব লিখেছি, সেখানে মিলেট, শাক, ডাল ইত্যাদির বিষয়ে উল্লেখ করেছি। আজ এই পর্বে একটু অন্য প্রকারের খাদ্যের কথা উল্লেখ করবো, যা বহুলভাবে ব্যবহৃত হলেও অতটা পরিলক্ষিত হয় না। ফার্মেন্টেড ফুড (Fermented foods) বা সন্ধানীকৃত খাদ্য এবং পানীয়ের কথা বলছি।
- সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
- 20 Jan 2025
ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় তাঁর 'বাঙালীর ইতিহাস' গ্রন্থে প্রাচীন বাংলায় বাঙালির খাদ্যতালিকায় ডালের অনুপস্থিতির কথা উল্লেখ করেছেন।
- সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
- 20 Jan 2025
বর্তমান পৃথিবীতে অন্যতম একটি সমস্যা হল 'মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ডেফিসিয়েন্সি' (Micro-nutrient deficiency), যা অনেক সময় 'হিডেন হাঙ্গার' (Hidden hunger) বলেও পরিচিত।
- সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
- 20 Jan 2025
ভারতবর্ষ ২০২৩ সালকে আন্তর্জাতিক মিলেট বৎসর হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব করেছিল, যা ফুড এবং এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (Food and Agriculture Organisation of United Nations) ও জাতিসংঘের (United Nations) সাধারণ পরিষদ অনুমোদন করেছে (FAO events)। আমরা এই পর্বে আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে মিলেট নিয়ে আলোচনা করবো।
- সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
- 17 Jan 2025
পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-১: সূচনা (Nutrition Security and Food – Part-1: Introduction)
বর্তমান ভারতবর্ষের তথা পৃথিবীর অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো অপুষ্টি। ভারতবর্ষের দিকে দৃকপাত করলে, ক্ষুধা এবং পুষ্টি সংক্রান্ত সমসাময়িক কালে যে সকল প্রতিবেদন উঠে আসছে তার কোনোটিই যে অতি আশাপ্রদ নয় এ কথা বলাই বাহুল্য। স্বাধীন ভারতবর্ষে দেশবাসীর খাদ্য সুরক্ষা হেতু একাধিক প্রকল্পের প্রবর্তন হয়েছে।
- সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
- 17 Jan 2025
খাদ্য থেকে পুষ্টি সংগৃহীত হয়, যার মাধ্যমে জীব প্রাণ ধারন করে। অতএব সকল জীবের ন্যায় মানুষের খাদ্য এবং পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। খাদ্য থেকে প্রাপ্ত শক্তি এবং খাদ্যগ্রহনের পর শারীরিক উপযুক্ততা জীবকে খাদ্য নির্ধারণে সহায়তা করে। আবার, আহার তালিকায় খাদ্যবস্তুর সংযোজন বা বিয়োজন হলো খাদ্যতালিকা বা আহারের রূপান্তর।
- সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
- 17 Jan 2025